বৃহস্পতিবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৫

সিলেট-মৌলভীবাজারে ইউরেনিয়ামের সন্ধান

সিলেট-মৌলভীবাজারে ইউরেনিয়ামের সন্ধান
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা সিলেট ও মৌলভীবাজারের পাহাড়ি অঞ্চলে মূল্যবান পারমাণবিক জ্বালানি ইউরেনিয়াম প্রচুর পরিমাণে রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। পরমাণু বোমার প্রধান উপকরণ হলো এই ইউরেনিয়াম।

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, দুই জেলার পাহাড়ি অঞ্চলে এই তেজস্ক্রিয় খনিজের ঘনত্বও অনেক বেশি। এখন সরকার এগিয়ে এলেই এই খনিজ থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।

সম্প্রতি রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের (বাপশক) সম্মেলন কক্ষে ‘ইউরেনিয়াম সার্চিং অ্যা- কোয়ান্টিফিকেশন : এন অ্যাটেম্পট অ্যা- সাকসেস’ শীর্ষক এক সেমিনারে এ তথ্য জানান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. একেএম ফজলে কিবরিয়া।

পরমাণু শক্তি কমিশনের নিউক্লিয়ার সেফটি, সিকিউরিটি ও সেফগার্ডস বিভাগের প্রধান এ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জানান, সিলেট ও মৌলভীবাজারের বেশ কয়েকটি স্থান থেকে উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয়তাসম্পন্ন পাথর সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এসব পাথরে ইউরেনিয়ামের উপস্থিতি রয়েছে। কিছু কিছু পাথরে উচ্চমাত্রার ইউরেনিয়ামও রয়েছে, যার ঘনত্ব ৫০০ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন) এরও বেশি।

ড. ফজলে কিবরিয়া জানান, পাথর সংগ্রহ করে ‘গামা স্প্রেকট্রোস্কপি’ পরীক্ষায় প্রাথমিকভাবে এগুলোতে ইউরেনিয়াম এর সন্ধান পাওয়া পায়। পরে ‘এনার্জি ডিসপার্সিব এক্সরে’ পরীক্ষার মাধ্যমে নমুনায় ইউরেনিয়ামসহ অন্যান্য সম্ভাব্য মৌল শনাক্ত করা হয়। তিনি জানান, কিছু কিছু পাথরে উচ্চমাত্রার ইউরেনিয়াম রয়েছে। এটা অত্যন্ত আশাব্যাঞ্জক খবর।

তিনি আরো জানান, জাপান ও কোরিয়ায় কয়েকটি নমুনা পাঠানো হয়েছিল। দুই দেশের পরীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফলের সাথে বাংলাদেশের ফলাফল সঙ্গতিপূর্ণ। এ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, এটাই বাংলাদেশে প্রথম চেষ্টা যার মাধ্যমে সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলাগুলোর নমুনা সংগৃহিত ঠিক কোন স্থানে কতো ঘনত্বের ইউরেনিয়াম রয়েছে, সেসব স্থানের জিপিএস রেকর্ড সংরক্ষিত রাখা হয়েছে।



ড. ফজলে কিবরিয়া জানান, দেশে ইউরেনিয়াম রয়েছে এমন খবর জানা থাকলেও লোকেশনের সঠিক ডাটাবেজের অভাবে সেসব ফলাফল বর্তমান সন্ধানে তেমন কাজেই আসেনি। এমনকি কোনো কোনো স্থানে ইউরেনিয়ামের কোনো অস্তিত্বই পাওয়া সম্ভব হয়নি। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) প্রকাশিত ইউরেনিয়াম উত্তোলন সম্বন্ধীয় বইয়ে উল্লেখিত তথ্য মতে, বিশ্বব্যাপী যেসব খনি থেকে বর্তমানে ইউরেনিয়াম উত্তোলন করা হচ্ছে সেগুলোর অধিকাংশতেই এর ঘনত্ব ৩০০-১০০০ পিপিএম। এটা খুশির খবর যে, আমাদেরও উত্তোলনযোগ্য ঘনত্বের ইউরেনিয়াম রয়েছে। এখন প্রয়োজন কতোটুকু এলাকাজুড়ে এমন ঘনত্বের ইউরেনিয়াম রয়েছে এবং দেশের আর কোথায় কোথায় এমন ঘনত্বের ইউরেনিয়াম রয়েছে তা খুঁজে বের করা। এ জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।

সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন ‘বাপশক’ এর পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক ড. দিলীপ কুমার সাহা, ভৌত বিজ্ঞান বিভাগের পরিচালক ড.
আলেয়া বেগম, মানবসম্পদ উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক প্রকৌশলী আনিছা বেগম, খাদ্য ও তেজস্ক্রিয় ইনিস্টিটিউটের পরিচালক ড. খোরশেদ আলম, বৈজ্ঞানিক তথ্য বিভাগের পরিচালক ড. হিমাংশু, প্রকৌশল বিভাগের পরিচালক প্রকৌশলী জাফর সাদেক, তেজস্ক্রিয় খনিজ ইউনিটের প্রাক্তন পরিচালক ড. ইউনুস আকন্দ প্রমুখ। সেমিনারে তেজস্ক্রিয় পদার্থের ওপর গবেষণা করেন এমন ১০০ জন বিজ্ঞানীও অংশ নেন।


ব্যাপক সম্ভাবনার হাতছানি, উদ্যোগ নেই ৪০ বছরেও

বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশন সূত্র জানায়, ১৯৭৫ সালে মৌলভীবাজার জেলার তৎকালীন কুলাউড়ার উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ফুলতলা ইউনিয়নের হারাগাছা পাহাড়ে সন্ধান পাওয়া যায় ইউরেনিয়ামের। পরবর্তীকালে তৎকালীন সিনিয়র ভূতত্ত্ববিদ ড. ইউনূস এর নেতৃত্বে কমিশনের একটি দল হারাগাছা পাহাড়ে অনুসন্ধান কাজ চালিয়ে ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করেন। কমিশনের অনুসন্ধানে ইউরেনিয়াম প্রাপ্তির সম্ভাবনাও নিশ্চিত হয়। তারপরও খনিজ পদার্থ আহরণ বা উত্তোলনের ব্যাপারে তখনো কোনো পদক্ষেপ সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি।

১৯৮০ সালে পুনরায় দেশের একমাত্র ইউরেনিয়াম প্রকল্প এলাকা হারাগাছা পাহাড়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করা হয়। সেইসাথে অন্যান্য খনিজ সম্পদের ব্যাপারেও ব্যাপক অনুসন্ধান চালানো হয়েছিল। পরবর্তীতে ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথে প্রকল্পটির কার্যক্রমগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে। ১৯৯১ সালে আবারো অনুসন্ধান কাজ শুরু হয়। সে সময়ে বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের সিনিয়র ভূতত্ত্ববিদ ড. ইউনূস জাপানের আণবিক জ্বালানি বিষয়ক গবেষণাগারে হারাগাছা এলাকা থেকে সংগৃহিত নমুনা পরীক্ষার পর এখানে ইউরেনিয়ামের অস্তিত্ব পুনরায় নিশ্চিত করেন। সেই সাথে এ পাহাড়ে তেল, গ্যাস ও কয়লা পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়।

অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, হারাগাছা ছাড়াও বৃহত্তর সিলেট ও চট্টগ্রামের আরো প্রায় তিন শতাধিক স্থানে প্রতি ১০ লাখ মাটিকণার মধ্যে ৫০০-১৩০০ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম কণা পাওয়া গেছে। অর্থাৎ এসব স্থানে ইউরেনিয়াম প্রাপ্তির হার ৫০০-১৩০০ পার্টস পার মিলিয়ন (পিপিএম)।

আণবিক শক্তি কমিশন সূত্রে জানা গেছে, পারমাণবিক বোমা তৈরি এবং পারমাণবিক চুল্লিতে শক্তি উৎপাদক হিসেবে এই তেজস্ক্রিয় পদার্থ ব্যবহৃত হয়। ২০০৯ সালের শেষ সময়ে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা কর্তৃক পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন পেয়েছে বাংলাদেশ। ফলে দেশে পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদনের মূল উপাদান ইউরেনিয়াম অনুসন্ধান ও উত্তোলন প্রয়োজন। ২০০৯ সালের ২৯ নভেম্বর সরকারের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) এনামুল হক সিলেটসফরকালে জানান, জুড়ী উপজেলায় আবিষ্কৃত ইউরেনিয়াম আকরিক প্রকল্পটি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে আণবিক শক্তি কমিশন। প্রাথমিক কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর জুড়ীতে আবিষ্কৃত ইউরেনিয়াম আকরিক প্রকল্প থেকে ইউরেনিয়াম উত্তোলনের উদ্যোগ নেয়া হবে। কিন্তু অধ্যাবধি বাস্তবে এ প্রকল্পের কোনো অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি।

ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতর এবং পারমাণবিক শক্তি কমিশন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, ১৯৮৫ সালে তৎকালীন মৌলভীবাজারের কুলাউড়া (বর্তমানে জুড়ী) উপজেলার ফুলতলা ও কুলাউড়া উপজেলার সাগরনাল এবং সিলেটের জৈন্তাপুর এলাকায় অনুসন্ধান চালিয়ে ইউরেনিয়ামের সন্ধান পাওয়া যায়। ইউরেনিয়াম অনুসন্ধানের জন্য গত ২৭ বছরে ওইসব এলাকায় ৩০টি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়েছে। ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ অধিদফরের সহাতায় এ কাজ করে পারমাণবিক শক্তি কমিশন। পরবর্তীতে পারমাণবিক শক্তি কমিশন খনন কাজ বন্ধ করে দেয়। পরে আর নতুন কোনো অনুসন্ধান চালানো হয়নি।

বাংলাদেশে এ পর্যন্ত প্রাপ্ত খনিজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদ জ্বালানি তেল, গ্যাস, কয়লা, চুনাপাথর, ইউরেনিয়াম, কাঁচবালি, চীনামাটি, কঠিন শিলা, পিট কয়লা, ভারি মেটাল ও লাইম স্টোন। মূল্যবান এসব খনিজ সম্পদের প্রায় সবকয়টিরই অস্তিত্ব রয়েছে সিলেট বিভাগে।

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে বড়লেখার হাকালুকি হাওরে পিট কয়লার সন্ধান পাওয়া গেছে। এ অঞ্চলে প্রাপ্ত খনিজ সম্পদ যথাযথভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হলে ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ মধ্যআয়ের দেশে পরিণত হবে। খনিজ সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার সম্ভব হলে মাথাপিছু এ দেশের জাতীয় আয় দাঁড়াবে ৮২৫ ডলার থেকে সাড়ে ৩ হাজার ডলারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার হারাগাছা পাহাড়ই নয়, কুলাউড়া উপজেলার সাগরনাল এবং সিলেট জেলার জৈন্তাপুরে ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে ইউরেনিয়াম আহরণ করলে দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী হবে। এছাড়া বড়লেখা উপজেলার সীমান্তবর্তী বোবারথল, সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার টেংরাটিলা, সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলার কৈলাশটিলায়ও ইউরেনিয়াম প্রাপ্তির উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।

মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান জানান, জুড়ীতে ইউরেনিয়াম, মাধবকুণ্ডের পেছনে সীমান্তবর্তী বিওসি টিলা ও ফুলছড়া চা বাগানে তৈলসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর রয়েছে। এইসব খনিজ সম্পদকে কাজে লাগানোর ব্যাপারে একটি রিপোর্ট খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় থেকে ২০১১ সালের নভেম্বর মাসের শেষদিকে একটি টিম মৌলভীবাজারে আসে। এরপর মন্ত্রণালয় থেকে অদ্যাবধি এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি। এবার নিদের্শনা আসলে কাজ শুরু করা হবে।More

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন