শুক্রবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৫

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.)

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.)
বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসে কালজয়ী চিরন্তন আদর্শ হিসেবে একমাত্র ইসলামই সব যুগে মানবসমাজে মানুষের মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিত করেছে। দুনিয়াবাসীর কাছে সর্বপ্রথম মানবাধিকারের পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা ঘোষণা করেন বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। ইসলাম ধর্ম প্রচারের প্রাথমিক অবস্থায় নবদীক্ষিত মুসলমানদের জীবনে যে অমানবিক অত্যাচার ও নিপীড়ন নেমে এসেছিল, তাতে মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়েছিল। আরবের কাফির-মুশরিকদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মানবতার মূর্ত প্রতীক নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মদিনায় হিজরত করেন। এত অত্যাচার সত্ত্বেও ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়ের পর মহানবী (সা.) সবাইকে ক্ষমা করে দেন। এভাবে আল্লাহর প্রিয় হাবিব (সা.) মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত জগদ্বাসীর সামনে উপস্থাপন করে রেখেছেন।

সভ্য দুনিয়ায় মানবাধিকারের ধারণার সূত্রপাত

পাশ্চাত্য সভ্যতায় প্রথম মানবাধিকারের ধারণার জন্ম হয় খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে প্রথম ঘোষিত হয় Declaration of the People’s Right এবং ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন সংবিধানে সংযোজিত হয় The Bill of Rights.এর পর থেকেই পাশ্চাত্য দুনিয়ায় মানবাধিকারের ধারণাটি বিকশিত হতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ববাসী এ বিষয়ে আরো সচেতন হয়ে ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ ৩০ ধারাসংবলিত সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ ঘোষণা করে। এ ঘোষণার মাধ্যমে বিশ্ববাসীর মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয় বটে; কিন্তু কোনো রাষ্ট্রের ওপর এই সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়নি।

মানবাধিকার সম্পর্কে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি

ফিতরাত তথা স্বভাবধর্ম ইসলাম মানবজীবনের জন্য উপযোগী আদর্শ পেশ করেছে। ইসলামে মানবাধিকার জীবনের সব দিক ও বিভাগে সমভাবে ব্যাপৃত। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবামূলক মৌলিক চাহিদাকেও ইসলাম মানবাধিকারে অন্তর্ভুক্ত করেছে। জীবনরক্ষার পাশাপাশি ব্যক্তির ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক তথা সব ক্ষেত্রে উপরোক্ত মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে। সর্বজনীন মানবাধিকারের মাইলফলক মহানবী (সা.)-এর বিদায় হজের ভাষণে তা স্পষ্ট। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ‘‘হে মানবজাতি! নিশ্চয়ই তোমাদের প্রভু এক। তোমাদের পিতা হজরত আদম (আ.) এক। সাবধান! ‘অনারবের’ ওপর ‘আরবের’ কিংবা ‘আরবের’ ওপর ‘অনারবের’, শ্বেতাঙ্গ মানুষের ওপর কৃষ্ণাঙ্গদের কিংবা কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের ওপর শ্বেতাঙ্গ মানুষের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই।”

ইসলামে মানুষের নিরাপত্তা

ইসলাম মানবজীবনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছে। মহান স্রষ্টা প্রাণ দানের মাধ্যমে মানবজীবনকে যেমন সম্মানিত করেছেন, তেমনি জীবন হরণকে করেছেন নিষিদ্ধ। শরিয়তে কেবল বিচারকের রায়ের মাধ্যমে কারো জীবন সংহার স্বীকৃত। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ যে প্রাণ হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন, যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে তাকে হত্যা কোরো না।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ৩৩)

আল্লাহ তাআলা আরো বলেছেন, ‘নরহত্যা অথবা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি ব্যতিরেকে কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন পৃথিবীর সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে হত্যা করল।’ (সুরা মায়েদা : ৩২)

সম্পদ ও সম্ভ্রম রক্ষার অধিকার

ইসলাম অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে উৎসাহ দেয় এবং বৈধ উপায়ে উপার্জিত সম্পদের নিরাপত্তা বিধান করে। বৈধ উপার্জনের অধিকার, তার মালিকানা রক্ষা, হস্তান্তর, দান এবং তা ভোগ করার অধিকার ইসলাম দিয়েছে। অন্যায়ভাবে তা গ্রহণ করাকে ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘তোমরা পরস্পরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস কোরো না।’ (সুরা বাকারা : ১২৮)

অন্যদিকে প্রত্যেক নাগরিকের ইজ্জত-আবরু রক্ষার গ্যারান্টি দেওয়া ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। মানুষের মর্যাদাহানি, হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য নিন্দা, কুৎসা রটানো, বিদ্রূপ ও উপহাস করা, নাম ও উপাধি বিকৃত করাকে নিষিদ্ধ করে পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘তোমাদের কোনো সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়কে হেয়প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে যেন বিদ্রূপ না করে।’ (সুরা হুজুরাত : ১১) এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণে বলেন, ‘তোমাদের রক্ত (জীবন), তোমাদের সম্পদ এবং তোমাদের ইজ্জত-সম্মান তোমাদের কাছে পবিত্র, যেমন পবিত্র তোমাদের আজকের এই দিন, তোমাদের এই শহর ও তোমাদের এই মাস।’ (সহিহ বুখারি, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ৬৩২)

ইসলাম ও ব্যক্তিস্বাধীনতা

ইসলামের দৃষ্টিতে প্রত্যেক মানুষই জন্মগতভাবে স্বাধীন। এই স্বাধীনতা আল্লাহ কর্তৃক প্রদেয় নিশ্চয়তা। যেকোনো ধরনের জোরজবরদস্তি ইসলামী রাষ্ট্রে সম্ভব নয়। ইসলামী নীতি অনুযায়ী কোনো উপযুক্ত আদালতে আইনানুযায়ী দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে কারাদণ্ড দেওয়া যাবে না। আইনের সুস্পষ্ট বিধান ছাড়া কাউকে অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার, আটক বা বল প্রয়োগ করা যাবে না এবং অভিযুক্ত ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থনে সমান সুযোগ থাকবে। বিচার কার্যক্রমে এ ন্যায়নীতি অনুসরণের ব্যাপারে কোরআনের সুস্পষ্ট নির্দেশ—‘তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য করবে, তখন ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে তা করবে।’ (সুরা নিসা : ৫৮) এ প্রসঙ্গে ইমাম মালেক (রহ.) বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার বা দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না এবং অভিযুক্ত ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থনে সুযোগ থাকবে।’ (ড. ম. ই পাটোয়ারী ও মো. আখতারুজ্জামান, মানবাধিকার ও আইনগত সহায়তাদানের মূলনীতি, পৃ. ৫)

নারীর অধিকার

নারীদের অধিকারের ব্যাপারে ইসলামই সর্বপ্রথম বাস্তব ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সম্পত্তির উত্তরাধিকার, বিবাহ, সম্মান প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাদের যথাযথ অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে। স্ত্রীর প্রতি আচরণ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘নারীদের তেমনি ন্যায়সংগত অধিকার আছে, যেমন আছে তাদের ওপর পুরুষদের।’ (সুরা বাকারা : ২২৮)

ইসলাম মায়ের পদতলে সন্তানের জান্নাত ঘোষণা করে নারীর মর্যাদা সমুন্নত করেছে। শরিয়তের সীমার মধ্যে থেকে নারীর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হওয়ার অধিকারেরও স্বীকৃতি দিয়েছে ইসলাম। আল্লাহ তাআলা এ ব্যাপারে বলেছেন, ‘তোমরা তা কামনা কোরো না, যা দ্বারা আল্লাহ তোমাদের কাউকে কারো ওপর মর্যাদা প্রদান করেছেন, পুরুষদের জন্য রয়েছে ওই অংশ, যা তাদের অর্জন, আর নারীদের জন্যও ওই অংশ, যা তাদের অর্জন।’ (সুরা নিসা  : ৩২)

সংখ্যালঘুদের অধিকার

ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের ন্যায়সংগত অধিকার অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জীবন ও সম্পত্তি, ইজ্জত-সম্মান, চাকরি ইত্যাদির নিরাপত্তার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও শিক্ষা গ্রহণের অধিকার রয়েছে। মদিনা সনদে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মদিনায় বসবাসের অধিকার দিয়েছিল। এমনকি তাদের একটি অংশ বিশ্বাসঘাতকতা করা সত্ত্বেও বাকি অংশের প্রতি অন্যায় আচরণ করা হয়নি। অমুসলিমদের ধর্মীয় উপাস্যদের নিন্দাবাদ ও গালমন্দকে কোরআন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এভাবে—‘আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য দেব-দেবীর উপাসনা যারা করে, তাদের উপাস্যদের তোমরা গালাগাল কোরো না।’ (সুরা আনআম : ১০৮) রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘অমুসলিমদের জীবন আমাদের জীবনের মতোই এবং তাদের সম্পদ আমাদের সম্পদের মতোই।’ রাসুল (সা.) আরো বলেছেন, ‘সাবধান! যদি কেউ কোনো মুআহিদের (চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিক) প্রতি জুলুম করে বা তাকে তার অধিকার থেকে কম দেয় কিংবা সাধ্যাতিরিক্ত কোনো কাজ তার ওপর চাপিয়ে দেয় অথবা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার থেকে কোনো মালামাল নিয়ে যায়, তাহলে কিয়ামতের দিন আমি তার বিরুদ্ধে থাকব।’ (আবু দাউদ, মিশকাত পৃ. ৩৫৪) মূলত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত মদিনা রিপাবলিকে ৬২২ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত ইসলামী রাষ্ট্রের লিখিত সংবিধান  Charter of Madina-জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবার অধিকার ও মর্যাদার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ইসলাম ঘোষিত সর্বজনীন, শাশ্বত ও চিরন্তন মানবাধিকারের নীতিসমূহ সর্বকালের ও সর্বযুগের বিপন্ন মানবতার মুক্তির প্রকৃত দিকনির্দেশক। ইসলাম শুধু মৌলিক মানবাধিকার সনদের ঘোষণা দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি; বরং ইসলামের সোনালি ইতিহাসে তার সফল বাস্তবায়নও করেছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন